পুরাতন দলিল পড়ার নিয়ম ও ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ
পুরাতন দলিল পড়ার নিয়ম সম্পর্কে আজকে আমি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। আমরা সবাই
পুরাতন দলিল পড়ার সময় শব্দের অর্থ গুলো বুঝতে পারিনা। যার কারণে বিভিন্ন পুরনো
দলিলগুলো আমরা ভালোভাবে পড়ে বুঝতে পারিনা। এজন্য আমি আজকে আপনাদের
সাথে পুরাতন দলিলের ১০০টি শব্দের অর্থের তালিকা প্রদান করব।
আজকের পর থেকে আপনারা খুব সহজেই যে কোন পুরনো দলিল পড়ে বুঝতে পারবেন যদি আপনি এই
আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়েন। তাহলে চলুন শুরু করা যাক
আজকের আলোচনা।
সূচিপত্র: পুরাতন দলিল পড়ার নিয়ম ও ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ
এই আর্টিকেলটিতে আমরা আলোচনা করবো:
পুরাতন দলিল পড়ার নিয়ম ও ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ
জমি বা সম্পত্তির পুরাতন দলিল পড়তে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। এতে এমন অনেক
শব্দ থাকে যা এখন আর দৈনন্দিন ব্যবহারে দেখা যায় না। কখনও আবার কিছু শব্দের
সংক্ষিপ্ত রূপ দেখে বোঝা যায় না তার আসল মানে। বিশেষ করে যদি আপনি আইনজীবী বা
ভূমি অফিসে অভ্যস্ত না হন তাহলে দলিল বোঝা আপনার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
পুরনো দলিল পড়ার নিয়ম (Step-by-Step গাইড)
পুরাতন দলিল পড়া মানে শুধু একটা কাগজ দেখা নয়— এটা একটা ভূমির তথ্য বিশ্লেষণের
কাজ। নিচে ধাপে ধাপে এর নিয়ম দেওয়া হলো:
১. দলিলের শিরোনাম দেখুন: দেখুন এটি কী ধরনের দলিল— বিক্রয়, দান, হেবা,
গিফট না কি বদল?
২. তারিখ ও দলিল নম্বর যাচাই করুন: পুরাতন দলিলে সন বা তারিখ বাংলায় বা
হিজরিতে থাকতে পারে। সেগুলো মিলিয়ে নিন।
৩. জমির পরিচিতি বোঝার চেষ্টা করুন
- দাগ নম্বর (Dag No.)
- খতিয়ান নম্বর (Khatian No.)
- মৌজা ও জে.এল. নম্বর
- জমির পরিমাণ, চৌহদ্দি (চারপাশের সীমানা)
৪. ক্রেতা ও বিক্রেতার পরিচয়: নাম, পিতা/স্বামীর নাম, গ্রাম, পেশা
ইত্যাদি ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন।
৫. "সাবেক" ও "হাল" তথ্য
- সাবেক বলতে পূর্বের দলিলের তথ্য বোঝায়।
- হাল বলতে বর্তমান মালিক বা আপডেট করা তথ্য বোঝায়।
৬. দলিল লেখকের নোট ও সাক্ষ্যকারীদের চিহ্নিত করুন: “বং”, “নিং”,
“সনাক্তকারী” — এই ধরনের শব্দ বুঝলে দলিলের সত্যতা যাচাই সহজ হয়।
পুরাতন দলিলে ব্যবহৃত ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও অর্থ
পুরাতন দলিলের ভাষা অনেকটাই একাডেমিক বা ফরমাল। নিচে সহজ ভাষায় এই শব্দগুলোর
অর্থ দেওয়া হলো যা আপনারা সবাই বুঝতে পারবেনঃ
ক্রম | শব্দ | অর্থ |
---|---|---|
১ | মৌজা | গ্রাম |
২ | জে.এল. নম্বর | মৌজা/গ্রামের নম্বর |
৩ | ফর্দ | দলিলের পাতা |
৪ | খং | খতিয়ান |
৫ | সাবেক | আগের/পূর্বের |
৬ | হাল | বর্তমান |
৭ | বং | বাহক (নিরক্ষরের পক্ষে লেখক) |
৮ | নিং | নিরক্ষর |
৯ | গং | অন্যান্য অংশীদার |
১০ | সাং | সাকিন/গ্রাম |
১১ | তঞ্চকতা | প্রতারণা |
১২ | সনাক্তকারী | বিক্রেতাকে চিনেন এমন ব্যক্তি |
১৩ | এজমালি | যৌথ |
১৪ | মুসাবিদা | দলিল লেখক |
১৫ | পর্চা | প্রাথমিক খতিয়ানের নকল |
১৬ | বাস্তু | বসতভিটা |
১৭ | বাটোয়ারা | সম্পত্তির বণ্টন |
১৮ | বায়া | বিক্রেতা |
১৯ | মং | মোট |
২০ | মবলক | মোট পরিমাণ |
২১ | এওয়াজ | সমমূল্যের বিনিময় |
২২ | হিস্যা | অংশ |
২৩ | একুনে | যোগফল |
২৪ | জরিপ | ভূমি পরিমাপ |
২৫ | চৌহদ্দি | সীমানা |
২৬ | সিট | মানচিত্রের অংশ |
২৭ | দাখিলা | খাজনার রশিদ |
২৮ | নক্সা | মানচিত্র |
২৯ | পিং | পিতা |
৩০ | জং | স্বামী |
৩১ | দাগ নম্বর | জমির নম্বর |
৩২ | স্বজ্ঞানে | নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে |
৩৩ | সমুদয় | সব কিছু |
৩৪ | ইয়াদিকৃত | আল্লাহর নামে শুরু |
৩৫ | পত্র মিদং | চিঠির মাধ্যমে |
৩৬ | বিং | বিস্তারিত |
৩৭ | দং | দখলকারী |
৩৮ | পত্তন | সাময়িক বন্দোবস্ত |
৩৯ | বদলসূত্র | জমি বিনিময় |
৪০ | মৌকুফ | মাফকৃত |
৪১ | দিশারী রেখা | দিক নির্দেশক রেখা |
৪২ | হেবা বিল এওয়াজ | বিনিময়ে জমি দান |
৪৩ | বাটা দাগ | বিভক্ত দাগ |
৪৪ | অধুনা | বর্তমান |
৪৫ | রোক | নগদ অর্থ |
৪৬ | ভায়া | বিক্রেতার পূর্ব দলিল |
৪৭ | দানসূত্র | দানকৃত জমি |
৪৮ | দাখিল-খারিজ | মালিকানা হস্তান্তর |
৪৯ | তফসিল | সম্পত্তির বিবরণ |
৫০ | খারিজ | পৃথক খাজনা অনুমোদন |
৫১ | খতিয়ান | জমির রেকর্ড |
৫২ | এওয়াজসূত্র | বিনিময়সূত্রে পাওয়া জমি |
৫৩ | অছিয়তনামা | উইল |
৫৪ | নামজারি | মালিকানা হস্তান্তরের রেকর্ড |
৫৫ | অধীনস্থ স্বত্ব | নিম্নস্তরের মালিকানা |
৫৬ | আলামত | মানচিত্রের চিহ্ন |
৫৭ | আমলনামা | দখলের দলিল |
৫৮ | আসলি | মূল জমি |
৫৯ | আধি | ফসলের ভাগ দেওয়া জমি |
৬০ | ইজারা | খাজনা নির্দিষ্ট করে ভাড়া |
৬১ | ইন্তেহার | ঘোষণাপত্র |
৬২ | এস্টেট | জমিদারি সম্পত্তি |
৬৩ | ওয়াকফ | ধর্মীয় কাজে দেওয়া সম্পত্তি |
৬৪ | কিত্তা | ভূমির খণ্ড |
৬৫ | কিস্তোয়ার জরিপ | খণ্ড ধরে জরিপ |
৬৬ | কায়েম স্বত্ব | চিরস্থায়ী মালিকানা |
৬৭ | কবুলিয়ত | স্বীকারোক্তি দলিল |
৬৮ | কান্দা | উঁচু ভূমি |
৬৯ | কিসমত | জমির ভাগ |
৭০ | খামার | নিজস্ব জমি |
৭১ | খিরাজ | খাজনা |
৭২ | খসড়া | প্রাথমিক দলিল |
৭৩ | গর বন্দোবস্তি | বন্দোবস্ত না হওয়া জমি |
৭৪ | গির্ব | বন্ধক |
৭৫ | জবরদখল | জোর করে দখল |
৭৬ | জোত | প্রজাস্বত্ব |
৭৭ | টেক | নদীর পলিতে গঠিত |
৭৮ | ঢোল সহরত | ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা |
৭৯ | তহশিল | রাজস্ব এলাকা |
৮০ | তামাদি | সময় অতিক্রম করা |
৮১ | তফসিল | সম্পত্তির বিস্তারিত |
৮২ | নামজারি | মালিকানা হস্তান্তর |
৮৩ | নথি | রেকর্ড |
৮৪ | দেবোত্তর | মন্দিরের নামে উৎসর্গ |
৮৫ | দখলী স্বত্ব | দখলের ভিত্তিতে মালিকানা |
৮৬ | দশসালা বন্দোবস্ত | ১০ বছরের চুক্তি |
৮৭ | দাগ নম্বর | জমির ক্রমিক নম্বর |
৮৮ | দরবস্ত | সব কিছু |
৮৯ | দিঘলি | নির্দিষ্ট খাজনা প্রদানকারী |
৯০ | নক্সা ভাওড়ন | পূর্ব জরিপের মানচিত্র |
৯১ | নাম খারিজ | পৃথককরণ |
৯২ | তুদাবন্দি | সীমানা নির্ধারণ |
৯৩ | তরমিম | সংশোধন |
৯৪ | তৌজি | চিরস্থায়ী রেকর্ড |
৯৫ | দিয়ারা | নদীর পলি জমা ভূমি |
৯৬ | ট্রাভার্স | জরিপ রেখা পরিমাপ |
৯৭ | খাইখন্দক | গর্তযুক্ত জলাশয় |
৯৮ | চর | নদীর পলিতে গঠিত ভূমি |
৯৯ | চৌহদ্দি | সীমানা |
১০০ | খাস | সরকারি জমি |
আপনি চাইলে এই তালিকাটি মোবাইলে সেভ করে রাখতে পারেন, দলিল পড়ার সময় এটি
দারুণ কাজে আসবে।
দলিল বোঝার সময় অতিরিক্ত যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি
১. চৌহদ্দি মিলিয়ে নিন: চারপাশের জমির সীমানা বুঝলে ভূমির প্রকৃত
অবস্থান স্পষ্ট হয়। তাই চৌহদ্দি মিলিয়ে নিন।
২. উৎস খুঁজুন: দলিলটি কার থেকে এসেছে তার উৎস খুঁজুন। যেমনঃ বায়া,
দান, বদলসূত্র ইত্যাদি
৩. দলিল নম্বরের ক্রম অনুসরণ করুন: যদি পুরাতন দলিলের ওপর হাল দলিল
হয়, তাহলে ক্রমানুসারে যাচাই করুন।
৪. সাক্ষী ও নোটারির উপস্থিতি: এটা দলিলের বৈধতা নিশ্চিত করে।
প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১। পুরাতন দলিল পড়া কেন কঠিন হয়?
কারণ এতে ব্যবহৃত ভাষা ও শব্দগুলো এখন আর প্রচলিত নয়। অনেক শব্দ হয়তো
সংস্কৃতভিত্তিক বা আইনি ভাষায় লেখা। যার কারণে পুরাতন দলের পড়া অনেক
কঠিন হয়ে যায়।
২। জে.এল. নম্বর বলতে কী বোঝায়?
জে.এল. মানে Jurisdiction List — এটি মৌজার নম্বর।
৩। দলিলের হাল মালিকানা কে কিভাবে বোঝা যাবে?
দলিলে উল্লেখিত "হাল খতিয়ান" ও "নামজারি" অংশ খেয়াল করুন, তাহলেই আপনি বুঝতে
পারবেন দলিলের হাল মালিকানা কার। আবারো হয়নি আবারও ভুল করেছেন।
উপসংহার
পুরাতন দলিল শুধু একটি কাগজ নয়— এটি জমির ইতিহাসের একটি দলিল। কিন্তু ব্যাখ্যা
বা পুরনো শব্দ না বোঝার কারণে আমরা বিভ্রান্ত হই। আপনি যদি উপরের নিয়মগুলো
অনুসরণ করেন এবং ১০০টি শব্দের তালিকাটি বুঝে নেন, তবে দলিল পড়া অনেক সহজ হয়ে
যাবে। এই তালিকাটি সেভ করে রাখুন — কারণ একদিন প্রয়োজনের সময় এটি অমূল্য
হয়ে উঠবে। যদি আরও কিছু জানতে চান বা কোনো শব্দ বুঝতে সমস্যা হলে নিচে
কমেন্ট করুন।