সৌদি আরবের বিখ্যাত জাদুঘর সমূহ | সৌদি আরবের সেরা দর্শনীয় জাদুঘর
সৌদি আরব শুধু মরুভূমি আর উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের দেশ নয়। এই দেশে রয়েছে ইতিহাস
ও সংস্কৃতির এক বিশাল ভাণ্ডার। সৌদি আরবের বিখ্যাত জাদুঘরগুলো সেই ইতিহাস আর
ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে তোলে।
এই আর্টিকেলে আমরা জানবো সৌদি আরবের সেরা ও জনপ্রিয় জাদুঘরগুলো সম্পর্কে, যা
আপনার সৌদি ভ্রমণকে আরও অর্থবহ করে তুলবে ইনশাআল্লাহ।
সূচিপত্রঃ সৌদি আরবের বিখ্যাত জাদুঘর সমূহ | সৌদি আরবের সেরা দর্শনীয় জাদুঘর
সৌদি আরবের জাদুঘর সম্পর্কে এই আর্টিকেলে আপনি যা কিছু জানতে পারবেন তা এক নজরে
দেখে নিন-
সৌদি আরবের বিখ্যাত জাদুঘর সমূহ | সৌদি আরবের সেরা দর্শনীয় জাদুঘর
অনেকেই সৌদি আরবকে হজ কিংবা ওমরাহর জন্যই চেনেন। কিন্তু এখানকার জাদুঘরগুলো
দেশটির দীর্ঘ ইতিহাস, প্রাচীন সভ্যতা আর আধুনিক উন্নয়নের কাহিনি চমৎকারভাবে
তুলে ধরে। জাদুঘরগুলোতে গেলে আপনি শুধু পুরনো নিদর্শনই দেখবেন না, বরং আপনি
জানেতে পারবেন এখানকার মানুষদের জীবনধারা, স্থাপত্য, ধর্মীয় ও সামাজিক
রীতিনীতির অজানা অনেক দিক।
সৌদি আরবের জাদুঘর দেখতে চাইলে
রিয়াদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম আপনার তালিকার শীর্ষে রাখুন। এখানে
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে ইসলামের আগমন এবং আধুনিক সৌদি আরবের বিকাশ
পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া মক্কার ইসলামিক মিউজিয়ামে রয়েছে দুর্লভ ধর্মীয় নিদর্শন, আর জেদ্দার
স্থানীয় জাদুঘরগুলো আপনাকে শহরের সংস্কৃতি ও জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
এভাবে সৌদি আরবের জাদুঘরগুলো একসাথে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আধুনিকতার গল্প ফুটিয়ে
তোলে।
সৌদি আরবের ঐতিহ্যবাহী জাদুঘর ও স্থানসমূহ
নাম | প্রদেশ | শহর/এলাকা | ধরন | গুগল ম্যাপ |
---|---|---|---|---|
আল বাসাম ঐতিহ্যবাহী বাড়ি | আল কাসিম | উনায়যা | ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ও জাদুঘর | লিংক |
মক্কার ক্লক টাওয়ার মিউজিয়াম | মক্কা | মক্কা | টাওয়ার জাদুঘর, ইসলামিক | লিংক |
দার আল মদিনা জাদুঘর | মদিনা | মদিনা | ইসলামিক ইতিহাস | লিংক |
দারাত সাফিয়া বিনজাগর আর্ট গ্যালারি | মক্কা | জেদ্দা | চিত্রকলা ও সংস্কৃতি | লিংক |
হফুফের স্থানীয় ইতিহাস জাদুঘর | পূর্বাঞ্চল (Ash Sharqiyah) | হফুফ | স্থানীয় ইতিহাস | লিংক |
হিজাজ রেলওয়ের ঐতিহাসিক জাদুঘর | মদিনা | মদিনা | রেলওয়ে ইতিহাস | লিংক |
মানবজাতির ঐতিহ্য প্রদর্শনী | মক্কা | আল-মুরসলাত | সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী | লিংক |
আল-উলার জাদেহ ঐতিহ্য জাদুঘর | মদিনা | আল-উলা | ঐতিহ্যবাহী প্রদর্শনী | লিংক |
জেদ্দা রিজিওনাল মিউজিয়াম (Khuzam Palace) | মক্কা | জেদ্দা | প্রত্নতত্ত্ব ও নৃ-তত্ত্ব | লিংক |
আল-জউফের প্রত্নতত্ত্ব ও লোকঐতিহ্য জাদুঘর | আল-জউফ | সাকাকাহ | প্রত্নতত্ত্ব ও ফোক কালচার | লিংক |
কিং আব্দুল আজিজ ঐতিহাসিক কেন্দ্র | রিয়াদ | রিয়াদ | ইতিহাস ও সংস্কৃতি কেন্দ্র | লিংক |
আল মদিনা মিউজিয়াম | মদিনা | মদিনা | ইসলামিক ইতিহাস | লিংক |
মাদাইন সালেহ (Hegra) | মদিনা | আল-উলা | প্রত্নতত্ত্ব (নবাতিয়ান) | লিংক |
রিয়াদের মাসমাক দুর্গ | রিয়াদ | রিয়াদ | ঐতিহাসিক দুর্গ | লিংক |
নাসিফ ঐতিহাসিক হাউস | মক্কা | জেদ্দা | ঐতিহ্য হাউস | লিংক |
সৌদি জাতীয় জাদুঘর | রিয়াদ | আল-মুরাব্বা | সৌদি জাতীয় জাদুঘর | লিংক |
রয়্যাল সৌদি বিমান বাহিনী মিউজিয়াম | রিয়াদ | রিয়াদ | সামরিক বিমান বাহিনী | লিংক |
আল-সালাম রয়েল প্যালেস | মক্কা | জেদ্দা | প্রাসাদ ও ইতিহাস | লিংক |
শাদ্দা ঐতিহাসিক প্রাসাদ | আসির | আভা | প্রাসাদ ও স্থানীয় ইতিহাস | লিংক |
তাইফের শরীফ ঐতিহ্য জাদুঘর | মক্কা | তাইফ | ঐতিহ্যবাহী জাদুঘর | লিংক |
তাবুকের প্রাচীন দুর্গ | তাবুক | তাবুক | ঐতিহাসিক দুর্গ | লিংক |
তৈয়বত ঐতিহাসিক জাদুঘর | মক্কা | জেদ্দা | ইসলামিক ও আরব ঐতিহ্য | লিংক |
দুই পবিত্র মসজিদের স্থাপত্য প্রদর্শনী | মক্কা | মক্কা | ইসলামিক স্থাপত্য | লিংক |
আল-জাহের প্রাসাদ ও মিউজিয়াম (Mecca Museum) | মক্কা | মক্কা | প্রাসাদ ও ইতিহাস | লিংক |
সৌদি আরবের সেরা ১০টি দর্শনীয় জাদুঘর
আমি এখানে যে সমস্ত সৌদি আরবের জাদুঘর সমূহ এর তালিকা প্রদান করেছি এই তালিকা
থেকে সেরা ১০টি জাদুঘরের তালিকা নিচে দেওয়া হল-
সৌদি আরবের জাতীয় জাদুঘর
সৌদি আরবের জাতীয় জাদুঘর (The National Museum) রিয়াদ শহরের কিং আব্দুল আজিজ
ঐতিহাসিক কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত একটি অত্যাধুনিক জাদুঘর। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত
হওয়া এই জাদুঘরটি সৌদি আরবের প্রাকৃতিক ইতিহাস থেকে শুরু করে ইসলামের উদ্ভব,
প্রথম ও তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশ এবং আধুনিক সৌদির উন্নয়ন পর্যন্ত
ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করে।
এই জাদুঘরে মোট আটটি আলাদা গ্যালারি রয়েছে। এখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগের
জীবাশ্ম, পাথরের সরঞ্জাম, ইসলামের শুরুর যুগের নিদর্শন, কাবার বিশালাকৃতির
মডেল, এবং হজের ইতিহাসের দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা রয়েছে। প্রতিটি জায়গায় আধুনিক
সুসজ্জিত আলো ও প্রজেকশন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রদর্শনীগুলো আরও জীবন্ত করে তোলা
হয়েছে, যা দর্শনার্থীদের এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।
এখানে গাইডেড ট্যুর, শিশুদের জন্য আলাদা শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম এবং বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী পর্যটকদের সুবিধার্থে আয়োজিত হয়। সপ্তাহের অন্যান্য
দিন এখানে সকালে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকলেও, শুক্রবারে সাধারণত বিকেল
থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সেরা জাদুঘর হিসেবে
বিবেচিত কারন এখানে সৌদি আরবের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে অত্যন্ত
আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
মাসমাক দুর্গ
মাসমাক দুর্গ (Masmak Fortress) সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের প্রাণকেন্দ্রে
অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গ, যা সৌদি দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছে। ১৮৬৫ সালে নির্মিত এই দুর্গ মূলত মাটি ও কাঁচ দিয়ে তৈরি,
যার মোটা দেয়াল এবং উঁচু প্রাচীর সৌদি মরুভূমির কৌশলগত প্রতিরক্ষার নিদর্শন
বহন করে।
১৯০২ সালে বাদশাহ আব্দুল আজিজ আল সৌদ এই দুর্গ আক্রমণ করে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের
মাধ্যমে রিয়াদ পুনর্দখল করেন। এই ঘটনাটি আধুনিক সৌদি আরব রাষ্ট্র গঠনের
সূচনালগ্নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই দুর্গ এখন একটি যাদুঘর হিসেবে
সংরক্ষিত, যেখানে সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের বিবরণ, বাদশাহের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র,
প্রাচীন নকশা ও জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
দুর্গের ভেতরে কাঠের দরজা, লোহার পেরেক বসানো মূল ফটক, খোলা প্রাঙ্গণ এবং
পর্যবেক্ষণ টাওয়ার দর্শকদের পুরনো সময়ের সৌদি আরবে নিয়ে যায়। এটি স্থানীয়
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, পর্যটক এবং ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
শুক্রবারে বিকেলের পর থেকে এবং সপ্তাহের অন্যান্য দিনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত
দুর্গটি খোলা থাকে।
মাদাইন সালেহ (Madain Salih)
মাদাইন সালেহ (Hegra), যা আরবিতে আল-হিজর নামেও পরিচিত, সৌদি আরবের আল-উলা
অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটি ছিল প্রায় ২০০০ বছর
আগে গড়ে ওঠা নবাতিয়ান সভ্যতার অন্যতম প্রধান নগরী। মাদাইন সালেহ সৌদি
আরবের প্রথম ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট (২০০৮), যা সৌদি দেশের
প্রাচীন ইতিহাস ও বৈচিত্র্যপূর্ণ স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন।
এখানে ১০০টিরও বেশি পাথরে খোদাই করা সমাধি রয়েছে, যেগুলোতে জটিল অলঙ্করণ,
আরামিক শিলালিপি ও নবাতিয়ান শিল্পের নিদর্শন দেখা যায়। এই সমাধি গুলো পাথরের
পাহাড় কেটে তৈরি করা, যা একসময় এখানকার অভিজাত ও বণিক শ্রেণির শবদাহের স্থান
ছিল। এছাড়া মাদাইন সালেহ ছিল প্রাচীন ধূপপথ (Incense Route)-এর গুরুত্বপূর্ণ
কেন্দ্র, যা দক্ষিণ আরব থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হতো।
বর্তমানে মাদাইন সালেহ পর্যটকদের জন্য একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানে গাইডেড
ট্যুরের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো ঘুরে দেখা যায়। এখানে প্রাচীন জলের
কূপ, মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এবং বিশাল পাথুরে পাহাড়ের শৈল্পিক সমাধি এক অনন্য
অভিজ্ঞতা এনে দেয়। মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই নিদর্শনগুলো সৌদি আরবের
অতীতকে মনে করিয়ে দেয়।
কিং আব্দুল আজিজ ঐতিহাসিক কেন্দ্র
কিং আব্দুল আজিজ ঐতিহাসিক কেন্দ্র (King Abdulaziz Cultural Center) সৌদি আরবের
রাজধানী রিয়াদের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি শুধু একটি জাদুঘর
নয়, বরং একটি বিস্তৃত কমপ্লেক্স, যেখানে সৌদি আরবের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা
নানা আঙ্গিকে সংরক্ষিত ও উপস্থাপিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে দেশের শতবর্ষ উদযাপনের
অংশ হিসেবে এই কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়।
এই কেন্দ্রে রয়েছে সৌদি আরবের জাতীয় জাদুঘর, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে
আধুনিক যুগ পর্যন্ত সৌদি ইতিহাসকে থিম্যাটিক গ্যালারির মাধ্যমে উপস্থাপন করে
আসছে। এছাড়া এখানে রয়েছে কিং আব্দুল আজিজের পুরোনো প্রাসাদের নিদর্শন,
জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, চিত্রশালা এবং মনোরম
সবুজ উদ্যান। বিশেষ করে এখানে রাখা বাদশাহ আব্দুল আজিজের ব্যক্তিগত সামগ্রী,
ঐতিহাসিক নথিপত্র ও ছবি ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য বড় আকর্ষণ।
পর্যটক ও গবেষকদের জন্য এই কেন্দ্রটি একটি জীবন্ত ইতিহাসের ক্লাসরুম। এখানে
নিয়মিতভাবে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম, শিশুদের ওয়ার্কশপ এবং আন্তর্জাতিক
প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রাজধানীর ব্যস্ত শহরের মাঝে এই কেন্দ্র ইতিহাস ও
সংস্কৃতির এক অনন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীকে আকর্ষণ
করে।
দুই পবিত্র মসজিদের স্থাপত্য প্রদর্শনী
দুই পবিত্র মসজিদের স্থাপত্য প্রদর্শনী (Exhibition of the Two Holy Mosques
Architecture) সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত এক অনন্য জাদুঘর। এখানে রয়েছে
ইসলামের ২টি পবিত্র মসজিদ, যেমনঃ মসজিদুল হারাম (মক্কা) ও মসজিদে নববী (মদিনা)।
এই জাদুঘর ২টি পবিত্র মসজিদের, স্থাপত্য ও উন্নয়নকে উপস্থাপন করে আসছে।
এই প্রদর্শনীতে প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে রাখা
হয়েছে। এখানে দুই মসজিদের পুরনো দরজা, মিম্বর, মিনার, দেয়ালের টুকরো এবং
এমনকি কাবা শরীফের কিসওয়া (পবিত্র গিলাফ)-এর প্রাচীন নমুনাও সংরক্ষিত রয়েছে।
কাবার কাঠের পুরনো দরজা এবং হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) প্রাচীন কাঠামোর অংশ
দেখার জন্য মুসলিম দর্শনার্থীরা এখানে ভিড় করেন।
প্রদর্শনীটি মূলত দুই পবিত্র মসজিদের সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ইতিহাসের
ধারাবাহিক বিবরণ দেয়। এখানে দুই মসজিদের বিভিন্ন যুগের মডেল, স্থাপত্যের নকশা
ও নথিপত্রও রাখা আছে। ফলে দর্শনার্থীরা বুঝতে পারেন কিভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী
ধরে এই দুই পবিত্র মসজিদের সৌন্দর্য, নিরাপত্তা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
মক্কায় হজ ও উমরাহ করতে আসা বহু যাত্রী এই প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন, যাতে তারা
ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র দুটি স্থানকে আরও গভীরভাবে জানতে পারেন। এটি নিঃসন্দেহে
মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক স্থান।
জেদ্দা রিজিওনাল মিউজিয়াম অফ আর্কিওলজি অ্যান্ড এথনোগ্রাফি (Khuzam Palace)
জেদ্দা রিজিওনাল মিউজিয়াম অফ আর্কিওলজি অ্যান্ড এথনোগ্রাফি (Jeddah Regional
Museum of Archaeology and Ethnography) সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দার
অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর। এটি Khuzam Palace ঐতিহাসিক প্রাসাদে
অবস্থিত, যা একসময় সৌদি সরকারের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে
এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ব ও নৃ-তত্ত্বের
ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
এই জাদুঘরে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে ইসলাম আগমনের পূর্ব ও পরবর্তী
সময়ের বহু দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। পাথরের তৈরি সরঞ্জাম, প্রাচীন মুদ্রা,
সিরামিক এবং ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি এখানকার গ্যালারিগুলোতে বিশেষভাবে স্থান
পেয়েছে। এছাড়া জেদ্দা এবং হিজাজ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, গহনা ও গৃহস্থালী
সামগ্রী দর্শনার্থীদের স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
জাদুঘরটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেনো, দর্শনার্থীরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌদি
সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তন অনুভব করতে পারেন। এর বাইরেও এখানে নিয়মিতভাবে
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যা জেদ্দার সাংস্কৃতিক জীবনকে
আরও সমৃদ্ধ করে। ফলে এই জাদুঘর শুধু পর্যটকদের জন্য নয়, গবেষক ও
ইতিহাসপ্রেমীদের কাছেও এক প্রিয় স্থান হয়ে উঠেছে।
তাবুক দুর্গ
তাবুক দুর্গ (Tabuk Fortress) সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তাবুক শহরে
অবস্থিত একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক দুর্গ, যা গভীরভাবে ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসকে
তুলে ধরে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই দুর্গের অবস্থান সেই বিখ্যাত তাবুক
অভিযান-সংক্রান্ত অঞ্চলে, যেখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৯ হিজরিতে (মিলাদী
৬৩০ সালে) ইসলামের প্রসার ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
প্রায় ১৫০০ বছরের পুরনো এই দুর্গ পরবর্তীতে বিভিন্ন যুগে সংস্কার ও
সম্প্রসারণের মাধ্যমে আরও দৃঢ় করা হয়। এর মধ্যে ওসমানীয় খিলাফত আমলেও
গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হয়। দুর্গের অভ্যন্তরে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ছোট
মসজিদ, জলাধার ও সুরক্ষিত কক্ষসমূহ, যা সেই সময়ের সামরিক ও সামাজিক
জীবনযাত্রার নিদর্শন তুলে ধরে।
বর্তমানে তাবুক দুর্গ একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে স্থানীয়
ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন মানচিত্র ও দলিল রাখা হয়েছে। এই
দুর্গের দেয়ালগুলো ঘুরে দেখা এবং উপরের টাওয়ার থেকে তাবুক শহরের দৃশ্য উপভোগ
করা পর্যটকদের কাছে দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।
তাবুক দুর্গ নিঃসন্দেহে সৌদি আরবের ইতিহাসপ্রেমী পর্যটক এবং ইসলামি ঐতিহ্য
অন্বেষণকারীদের জন্য এক অবিস্মরণীয় স্থান। এখানকার পরিবেশে দাঁড়িয়ে একপ্রকার
অতীতের স্পন্দন অনুভূত হয়, যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে রাখে।
তৈয়বত জাদুঘর
তৈয়বত জাদুঘর (Al Taybat International City Museum of Science and
Information) সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে অবস্থিত একটি ব্যতিক্রমী ও সমৃদ্ধ জাদুঘর,
যা মূলত আরব-ইসলামী ইতিহাস, হিজাজি সংস্কৃতি এবং বিশ্বসভ্যতার বহু দিককে
অত্যন্ত নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে। এটি একটি বৃহৎ প্রাইভেট কমপ্লেক্স, যা
ঐতিহ্যবাহী হিজাজি স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত এবং বহু ভবনের সমন্বয়ে গঠিত।
প্রায় ১০,০০০ এরও বেশি দুর্লভ নিদর্শন এই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। এখানে রয়েছে
প্রাচীন হস্তলিখিত কুরআন, ইসলামের ইতিহাসের নানা শিল্পকর্ম, পুরনো মুদ্রা,
ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও গৃহস্থালী সামগ্রী। এছাড়াও সৌদি আরবের প্রাক-ইসলামিক সময়
থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষিত
রয়েছে।
তৈয়বত জাদুঘরের আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো এখানকার মিনিয়েচার মডেল, যেখানে
প্রাচীন মক্কা, মদিনা এবং জেদ্দার ঐতিহাসিক নগর চিত্র, শহরের ফটক ও বাজার
চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া এখানে ইসলামী স্থাপত্যের জটিল কারুকাজ
থেকে শুরু করে আরবি ক্যালিগ্রাফির চমৎকার নমুনাও দেখা যায়।
শুধু ইতিহাস নয়, এখানে বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কেও আলাদা গ্যালারি
রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের বহুমাত্রিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেয়। ফলে তৈয়বত জাদুঘর
জেদ্দায় ভ্রমণরত যে কোনো পর্যটকের জন্য এক অতুলনীয় সাংস্কৃতিক গন্তব্য, যা
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্পের এক অনন্য মিশেল উপহার দেয়।
আল-মদিনা জাদুঘর
আল-মদিনা জাদুঘর (Dar Al Madinah Museum) ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্র নগরী মদিনায়
অবস্থিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় জাদুঘর। এটি মদিনা মনোয়ারার
সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে একটি অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ
করছে। মূলত হিজাজ রেলওয়ের ঐতিহাসিক স্টেশন প্রাঙ্গণে স্থাপিত এই জাদুঘর শহরের
অতীতের সঙ্গে বর্তমানের এক গভীর সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।
জাদুঘরের ভেতরে বিস্তৃত গ্যালারিগুলোতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরতের
(মক্কা থেকে মদিনায় আগমন) ইতিহাস থেকে শুরু করে মদিনার বিভিন্ন যুগের
রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্থাপত্যগত বিবর্তন উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে প্রাচীন
চিঠিপত্র, মুদ্রা, নকশা, মডেল এবং ইসলামের শুরুর সময়কার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ
নিদর্শন দেখা যায়।
বিশেষ করে মদিনার ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর (মসজিদে নববীসহ) সম্প্রসারণ ও পরিবর্তনের
নানা পর্যায়ের নকশা ও আলোকচিত্র দর্শনার্থীদের অত্যন্ত আকৃষ্ট করে। এছাড়া
মদিনার প্রাচীন প্রাচীর, বাজার, পানির চ্যানেল এবং হিজাজ রেলওয়ের ইতিহাসও
এখানে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এই জাদুঘর শুধু একটি জাদুঘর নয় বরং ইসলামী ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল, যা আপনাকে
প্রায় দেড় হাজার বছর পেছনের এক অতীতকে মনে করিয়ে দিবে।।
রয়্যাল সৌদি এয়ার ফোর্স মিউজিয়াম
রিয়াদে অবস্থিত রয়্যাল সৌদি এয়ার ফোর্স মিউজিয়াম (Saqer Al-Jazirah Royal
Air Force Museum), যা স্থানীয়ভাবে “সকাকার মিউজিয়াম” নামেও পরিচিত। এটি এমন
একটি বিশেষ স্থান যা সৌদি আরবের সামরিক ইতিহাসে বিমান বাহিনীর গৌরবময় ভূমিকা
তুলে ধরে। অত্যাধুনিক প্রদর্শনী ও উন্মুক্ত স্থানের প্রদর্শিত বিমানসমূহ এই
দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় সামরিক জাদুঘরে পরিণত করেছে।
জাদুঘর প্রাঙ্গণে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই আপনারা দেখতে পাবেন বিভিন্ন যুগের
যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্রের বিভিন্ন মডেল। এখানে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের বিভিন্ন বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত বিমান
একসাথে দেখা যায়, যা সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা ইতিহাসের ধারাবাহিক উন্নতির
সাক্ষ্য দেয়।
ভেতরের গ্যালারিতে রয়েছে বিমান বাহিনীর জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা
দুঃসাহসিক মিশন, যুদ্ধের ইতিহাস এবং এভিয়েশনের প্রগতির গল্প। প্রাচীন নথিপত্র,
যুদ্ধকালীন ছবি, পাইলটদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও ইউনিফর্ম সমূহ এখানে সংরক্ষণ করা
রয়েছে।
বিশেষ করে শিশু ও তরুণ দর্শনার্থীদের জন্য এখানে ইন্টারেক্টিভ ডিসপ্লে এবং
সিমুলেটর রাখা হয়েছে। এখানে তারা ফ্লাইট এক্সপেরিয়েন্সের স্বাদ নিতে পারবে।
ফলে এই জাদুঘর শুধু ইতিহাস দেখা বা জানার জন্য নয় বরং উড্ডয়নের স্বপ্ন ও
বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য এক অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক স্থান।
সংক্ষিপ্ত মন্তব্যঃ সৌদি আরবের বিখ্যাত জাদুঘরগুলো শুধু স্থাপনা নয়,
এগুলো সময়ের খাতায় লেখা গল্প। রিয়াদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম থেকে শুরু করে
জেদ্দার ছোট ছোট হেরিটেজ সেন্টার পর্যন্ত প্রতিটি জায়গা আপনাকে অন্য এক সৌদি
আরব দেখাবে। তাই পরের বার সৌদি আরবে কোনো জায়গায় ঘুরতে গেলে অন্তত এই ১০টি
জাদুঘর আপনার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখুন।
সৌদি আরবের জাদুঘর খোলার সময়সূচি
সৌদি আরবে সরকারি অফিস, স্কুল, ব্যাংক ও অন্যান্য অফিসের সাপ্তাহিক ছুটি মূলত
শুক্রবার এবং শনিবার। তবে জাদুঘর, শপিং মল, পার্ক বা পর্যটন কেন্দ্রের জন্য এ
নিয়ম অনেকটা আলাদা হয়। সৌদি আরবের বেশিরভাগ জাদুঘর এই ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ
থাকে না, কারণ ছুটির দিন দর্শনার্থীর ভিড় বেশি হয়।
তাই এখানে শুক্রবার প্রায় সব জাদুঘর সকালে বন্ধ রাখে, কিন্তু বিকেল খোলে। যাতে
সকলে জুমার নামাজের পর পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসতে পারে। এখানে জাদুঘর গুলো শনিবার
পুরোপুরি খোলা থাকে কারণ পরিবারিক ভ্রমণের জন্য সৌদি আরবে অন্যতম প্রধান একটি
দিন। রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার অফিসের নিয়মমতো স্বাভাবিক সময়ে খোলা হয়।
তাহলে সপ্তাহের কোন দিন অনেক জাদুঘর পুরোপুরি বন্ধ থাকে?
সৌদির অনেক বড় সরকারি জাদুঘর রবিবার বা সোমবারে বন্ধ রাখে। কারণ তখন তাদের
“maintenance day” হিসেবে ধরা হয়। এটি সৌদির মিউজিয়ামগুলোর খুব প্রচলিত
ব্যবস্থা। কিন্তু এটি আলাদা আলাদা মিউজিয়ামভেদে ভিন্ন হয়।
FAQ
১। সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় জাদুঘর কোনটি?
উত্তরঃ রিয়াদে অবস্থিত ন্যাশনাল মিউজিয়াম সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ
জাদুঘর। এখানে ৮টি গ্যালারিতে সাজানো অসংখ্য নিদর্শন আছে।
২। সৌদি আরবের জাদুঘর কখন খোলা হয়?
উত্তরঃ সৌদি আরবের জাদুঘরগুলো সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা
থাকে। শুক্রবারে দুপুরের পর থেকে খোলা হয়। তবে ভ্রমণের পূর্বে সঠিক সময় জানার
জন্য জাদুঘর গুলোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
৩। সৌদি আরবের জাদুঘরগুলোতে ঢুকতে টিকিট লাগে?
উত্তরঃ হ্যাঁ সৌদি আরবে প্রায় সব বড় জাদুঘরে টিকিট ফি আছে। অনেক সময় বিশেষ
দিনে বা ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফ্রি এন্ট্রি দেওয়া হয়।
উপসংহার
সৌদি আরবের বিখ্যাত জাদুঘরগুলো শুধু ঘুরে দেখার জন্যই নয়, বরং এই জাদুকরগুলো
থেকে অনেক কিছু শিখতে ও অনুভব করতে পারবেন। এই জাদুঘরগুলোর প্রতিটি গ্যালারি
যেন ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে উঠে আসা একেকটি গল্প। আপনি এই মিউজিয়াম গুলোতে
পরিবারসহ যান কিংবা একা যান, আপনার মনে হবে যে আপনি সময়ের গভীরে হারিয়ে
গেছেন। তাই সৌদি আরব ভ্রমণে গেলে অন্তত একটি বিখ্যাত জাদুঘর ঘুরে দেখে আসুন, যা
আপনার ভ্রমণকে আরও সমৃদ্ধ করবে।