শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ
শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ জানাটা অনেক
গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যারা সিজনাল রাইনাইটিস, হাঁপানি, সর্দি বা অ্যালার্জি
জাতীয় সমস্যায় ভুগছেন। এই আর্টিকেলে আপনি পাবেন অ্যান্টিহিস্টামিন,
ব্রঙ্কোডায়লেটর, ইনহেলড স্টেরয়েড ও কাশির ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সব জেনেরিক নামের
বিস্তারিত তালিকা এবং তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে।
সাধারণ পাঠকগণ যেন সহজে বুঝতে পারেন, সেই জন্য প্রতিটি ওষুধের কাজ এখানে ব্যাখ্যা
করেছি। শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির অসুখ ও ওষুধ সম্পর্কেও সচেতনতা গড়ে তুলতে
এই কনটেন্টটি খুবই কার্যকর হবে। আপনি যদি ঘন ঘন কাশি বা শ্বাসকষ্টে ভোগেন, তাহলে
শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ নিয়ে এই তথ্যভিত্তিক
লেখাটি আপনার জন্য হেল্পফুল হবে।
সূচিপত্রঃ শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ
এই আর্টিকেল থেকে আপনি যে সমস্ত তথ্য গুলো জানতে পারবেন তা এক নজরে দেখে নিন-
- শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ
- কাশি কমানোর ঘরোয়া উপায়
- রাতে কাশি কমানোর উপায়
- শুকনো কাশি কিসের লক্ষণ
- নাকের এলার্জি দূর করার ঘরোয়া উপায় ও নাকের এলার্জি থেকে মুক্তির উপায়
- হাঁপানি রোগের লক্ষণ
- হাঁপানি রোগের আধুনিক চিকিৎসা
- হাঁপানি কি ভালো হয়?
- অ্যাজমা কত প্রকার?
- প্যারোক্সিসমাল নিশাচর শ্বাসকষ্ট কী?
- হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে করণীয়
- FAQs
- উপসংহার
শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ
এন্টিহিস্টামিন ওষুধ কী?
এন্টিহিস্টামিন হলো এমন ওষুধ যা শরীরে অ্যালার্জির সময় নিঃসৃত হিস্টামিন নামক
রাসায়নিকের কাজ কমায়। হিস্টামিন চুলকানি, হাঁচি, নাক ও চোখ দিয়ে পানি পড়া ও
শ্বাসকষ্টের মত উপসর্গ সৃষ্টি করে। এন্টিহিস্টামিন ওষুধ এই উপসর্গগুলো কমাতে
সাহায্য করে।
এন্টিহিস্টামিন নতুন প্রজন্ম:
- সিটিরিজিন (Cetirizine),
- লেভোসিটিরিজিন (Levocetirizine),
- লোরাটাডিন (Loratadine),
- ডেসলোরাটাডিন (Desloratadine),
- ফেক্সোফেনাডিন (Fexofenadine)
এগুলো খেলে খুব বেশি সমস্যা হয় না তাই দিনে এই ওষুধ নিরাপদে ব্যবহার করা যায়।
এন্টিহিস্টামিন পুরনো প্রজন্ম:
- ক্লোরফেনিরামিন (Chlorpheniramine),
- ডাইফেনহাইড্রামিন (Diphenhydramine)
এগুলো সাধারণত রাতে ব্যবহৃত হয় কারণ এগুলো খেলে ঘুম প্রচুর আসে।
আরো পড়ুনঃ ঔষধের জেনেরিক নাম ও কাজ
শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ নিম্নে নিচে দেওয়া
হল-
A) অ্যালার্জির ওষুধ (Antihistamines)
👉 হাঁচি, কাশি, চুলকানি, সিজনাল রাইনাইটিস ও ত্বকের অ্যালার্জিতে ব্যবহৃত হয়।
- Bilastine, Ebastine, Rupatadine - নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিহিস্টামিন।
- Cetirizine, Levocetirizine, Loratadine, Desloratadine, Fexofenadine - নাক বন্ধ, হাঁচি ও চোখ চুলকানিতে কার্যকর।
- Chlorpheniramine, Diphenhydramine, Mebhydrolin - পুরনো প্রজন্মের অ্যান্টিহিস্টামিন, ঘুমাতে সাহায্য করে।
- Ketotifen - অ্যালার্জিক অ্যাজমা প্রতিরোধে সহায়ক।
- Olopatadine - চোখের অ্যালার্জি ও কনজাংটিভাইটিসে ব্যবহৃত হয় (আই ড্রপস হিসেবে)।
- Azelastine - নাক ও চোখের অ্যালার্জির জন্য স্প্রে বা ড্রপ আকারে।
B) হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের ওষুধ (Anti-Asthmatic)
1. Leukotriene Receptor Antagonist (LTRAs)
👉 হাঁপানির দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়।
- Montelukast
- Pranlukast
- Zafirlukast
2. Bronchodilators ও Inhaled Corticosteroids (MDI/DPI)
👉 হাঁপানি ও COPD রোগীদের শ্বাসপ্রশ্বাস সহজ করতে ব্যবহৃত হয়।
- Salbutamol, Levosalbutamol - জরুরি ক্ষেত্রে দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস খুলে দেয়।
- Salbutamol + Ipratropium - অ্যাজমা ও COPD-তে ডুয়াল অ্যাকশন।
- Formoterol, Tiotropium, Indacaterol + Glycopyrronium - দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টে।
- Budesonide, Beclomethasone, Fluticasone - ইনহেলড স্টেরয়েড যা ইনফ্ল্যামেশন কমায়।
- Salmeterol + Fluticasone, Beclomethasone + Formoterol - ICS ও LABA কম্বিনেশন।
3. Phosphodiesterase Inhibitors
👉 শ্বাসনালির পেশি শিথিল করে শ্বাসপ্রশ্বাসে সহায়তা করে।
- Doxofylline
- Theophylline
- Roflumilast - দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট (COPD)-এ ব্যবহৃত হয়।
C) কাশি ও ঠান্ডার ওষুধ (Cough & Cold Preparations)
1. Expectorant / Mucolytic (চেস্টি কাশি বা ভেজা কাশি)
👉 বুকের কফ সহজে বের করতে সাহায্য করে।
- Ambroxol
- Guaifenesin + Diphenhydramine + Levomenthol
- Guaifenesin + Dextromethorphan + Menthol
- Vasakarista - প্রাকৃতিক হারবাল কাশির সিরাপ।
- Sodium Chloride Nasal Drop/Spray
- Acetylcysteine - ঘন কফ ভাঙতে সহায়তা করে।
2. Antitussive (শুকনা কাশি বা ড্রাই কাশি দমনকারী)
👉 শুকনা ও খুসখুসে কাশিতে ব্যবহৃত হয়।
- Butamirate Citrate
- Dextromethorphan + Phenylephrine + Triprolidine
- Dextromethorphan
- Codeine Phosphate - তীব্র শুকনা কাশিতে ব্যবহৃত হয়, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ।
D) ইনহেলড কর্টিকোস্টেরয়েড + লং-অ্যাক্টিং বিটা-২ অ্যাগোনিস্ট (ICS + LABA)
👉 মডারেট থেকে সিভিয়ার অ্যাজমা ও সিওপিডিতে ব্যবহৃত হয়।
- Mometasone + Formoterol
- Fluticasone + Salmeterol
- Budesonide + Formoterol
E) লং-অ্যাক্টিং মাসকারিনিক অ্যান্টাগোনিস্ট (LAMA)
👉 দীর্ঘমেয়াদি সিওপিডি বা শ্বাসকষ্টের রোগে ব্যবহৃত হয়।
- Tiotropium
- Glycopyrronium
- Revefenacin
- Aclidinium
- Umeclidinium
F) অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ
- Oxymetazoline - নাক বন্ধ থাকলে নাজাল স্প্রে হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- Xylometazoline - সর্দি ও নাক বন্ধে কার্যকর (নাকের ড্রপ/স্প্রে)।
কাশি কমানোর ঘরোয়া উপায়
কাশি খুব সাধারণ একটি সমস্যা হলেও, যখন এটা ঘন ঘন হতে থাকে তখন তা অনেকটাই
বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। অনেকেই এমন সময় ওষুধ না খেয়ে প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া সমাধান
খোঁজেন, যা নিরাপদ ও কার্যকর। গরম পানির ভাপ নেয়া কাশি কমানোর অন্যতম সহজ উপায়।
এটা শ্বাসনালির মিউকাস পাতলা করে, ফলে কফ সহজে বেরিয়ে আসে এবং গলায় জ্যাম ভাব
কমে যায়।
আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিস ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ
মধু হলো আরেকটি অসাধারণ ঘরোয়া উপাদান, যেটা প্রাকৃতিক কাশিনাশক হিসেবেই কাজ
করে। এক চা চামচ মধু একটু গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে কাশি ও গলার জ্বালাভাব
অনেকটা কমে যায়। আপনি চাইলে এক চিমটি লেবুর রস বা আদা মিশিয়ে বিতে পারেন, তাহলে
আরো ভাল ফল পাবেন। আবার আদা চা, তুলসীপাতা ও লং একসঙ্গে ফুটিয়ে খেলেও কাশি
প্রশমিত করতে পারে।
গলা পরিষ্কার রাখতে লবণ-পানির গারগল অত্যন্ত কার্যকর। এটি শুধু গলা ব্যথা কমায়
না, বরং ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরক্ষা তৈরি করে। কাঁচা
হলুদের রস, লবঙ্গ বা মিসরি চুষে খাওয়াও শুকনা কাশির ক্ষেত্রে আরামদায়ক হতে
পারে।
তবে মনে রাখা জরুরি যে ঘরোয়া উপায়গুলো সাধারণ কাশি বা ঠান্ডা-জনিত সমস্যায়
কার্যকর। যদি আপনার কাশি দীর্ঘমেয়াদি হয় ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, বা রক্ত ওঠে তবে
দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রাতে কাশি কমানোর উপায়
দিনের তুলনায় রাতের বেলা কাশি অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে, বিশেষ করে খুসখুসে
শুকনো কাশির ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়। কারণ শুয়ে থাকার সময় গলার পিছনে জমে থাকা
মিউকাস গলা চুলকানি বাড়িয়ে তোলে, ফলে ঘন ঘন কাশি শুরু হয়। এই সমস্যা থেকে
মুক্তি পেতে রাতে ঘুমানোর আগে কয়েকটি সহজ উপায় মেনে চললে অনেক উপকার পাওয়া
যায়।
প্রথমত, ঘুমানোর আগে হালকা গরম পানি পান করতে পারেন কিংবা মধু মেশানো লেবু-চা
খাওয়া যেতে পারে। এতে গলা নরম রাখতে সাহায্য করে এবং গলার শুষ্কতা কমায়। ফলে
কাশি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘুমানোর আগে এক চামচ খাঁটি মধু খেতে পারেন। এটা
গলায় একটি প্রাকৃতিক কোট তৈরি করে, যা কাশির রিফ্লেক্স কমিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, বালিশ একটু উঁচু করে ঘুমানো উচিত। এতে গলায় মিউকাস জমতে পারে না
এবং শ্বাসনালিতে চাপ কমে। এছাড়া ঘরের বাতাসে আর্দ্রতা ধরে রাখাও
গুরুত্বপূর্ণ। আপনি চাইলে একটি হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন বা এক বাটি
গরম পানি রুমে রেখে দিতে পারেন। এতে শুষ্ক বাতাস নরম হয়, যা গলায় আরাম দেয়।
রাতে ঠান্ডা বাতাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত, কারণ ঠান্ডা বাতাস অনেক
সময় কাশির প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
শুকনো কাশি কিসের লক্ষণ
শুকনো কাশি সাধারণত এমন এক ধরনের কাশি, যেখানে কফ বের হয় না। এই কাশিতে
শুধু গলার ভিতরে খুশখুশে অনুভূতি হয় এবং বারবার কাশি পেতে থাকে। এটি কোনো
একক রোগ নয়, বরং শরীরের ভেতরের বিভিন্ন সমস্যার প্রাথমিক ইঙ্গিত হতে পারে
এটি। অনেক সময় ভাইরাল সংক্রমণ বা সর্দি-জ্বরের পর শুকনো কাশি কয়েকদিন থেকে
যায়। এছাড়া অ্যালার্জি, ধুলাবালি, ধোঁয়া বা দূষণের সংস্পর্শেও এই ধরনের
কাশি দেখা দিতে পারে।
শুকনো কাশি অনেক সময় অ্যাসিড রিফ্লাক্স (GERD) এর উপসর্গ হিসেবেও
প্রকাশ পায়, যেখানে পাকস্থলীর অ্যাসিড গলা অবধি উঠে গিয়ে কাশি সৃষ্টি করে।
আবার হাঁপানি বা ব্রঙ্কাইটিসের শুরুতেও কাশি শুকনো প্রকৃতির হয়ে থাকে। কিছু
ওষুধ যেমনঃ ব্লাড প্রেশারের জন্য ব্যবহৃত ACE inhibitor জাতীয় ওষুধ,
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শুকনো কাশি সৃষ্টি করতে পারে।
নাকের এলার্জি দূর করার ঘরোয়া উপায় ও নাকের এলার্জি থেকে মুক্তির উপায়
নাকের এলার্জি বা অ্যালারজিক রাইনাইটিস এমন এক বিরক্তিকর সমস্যা, যা
ধুলাবালি, ফুলের রেণু, ঠান্ডা বাতাস বা পোষা প্রাণীর লোমে হয়ে থাকে। যার
ফলে হঠাৎ হাঁচি, নাক চুলকানো বা পানি ঝরার সমস্যা দেখা দেয়। তবে কিছু
ঘরোয়া উপায় মেনে চললে এই অ্যালার্জি থেকে অনেকটা আরাম পাওয়া যায়।
প্রথমেই নাক পরিষ্কার রাখা গুরুত্বপূর্ণ। দিনে কয়েকবার লবণ-পানির স্যালাইন
ব্যবহার করে নাক ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে অ্যালার্জেনগুলো ধুয়ে যায়। আদা-চা,
কাঁচা হলুদের দুধ বা কালোজিরা-মধু মিশিয়ে খেলে শরীরের ইমিউন রেসপন্স ভালো
থাকে এবং অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া কমে।
ঘরের ধুলাবালি কমাতে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। বিছানার
চাদর, পর্দা বা বালিশের কাভার মাঝে মাঝে গরম পানিতে ধুয়ে নিলে অ্যালার্জি
সৃষ্টি করা ডাস্ট মাইট কমে যায়। যাদের গরমে নাক বন্ধ হয়ে পড়ে, তারা রাতে
ঘুমানোর আগে এক বাটি গরম পানির ভাপ নিতে পারেন। এতে নাক খুলে যায় এবং আরাম
পাওয়া যায়।
নাকের এলার্জি থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে হলে শুধুমাত্র ওষুধের উপর নির্ভর
না করে, অ্যালার্জি ট্রিগারগুলোকে চিহ্নিত করা এবং তা থেকে নিজেকে দূরে
রাখা সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।
প্রথম ধাপে, কার কী কারণে এলার্জি হয় তা বুঝে নেওয়া জরুরি, কারণ কেউ ফুলের
রেণুতে, কেউবা ঠান্ডায়, আবার কেউ ধুলাবালিতে এই এলার্জিতে আক্রান্ত হন।
একবার কারণ চিহ্নিত হবার পর প্রতিদিন মাস্ক ব্যবহার করলে, বাইরের
ধুলো-ধোঁয়া এড়িয়ে চললে ও ঘর পরিষ্কার রাখলে সহজে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা
যায়।
দ্বিতীয়ত, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিহিস্টামিন ও
প্রয়োজনে নাকের স্প্রে (যেমন অক্সিমেটাজোলিন বা অ্যাজেলাস্টিন) ব্যবহার
করলে এই সমস্যা থেকে দ্রুত উপশম মেলে। এই সমস্যা থেকে দীর্ঘমেয়াদি মুক্তির
জন্য কেউ কেউ ইমিউনোথেরাপির পরামর্শও নিয়ে থাকে।
তবে প্রতিদিনের জীবনযাপনে কিছু ছোট পরিবর্তন যেমনঃ পোষা প্রাণী বিছানায় না
রাখা, ঘরের জানালা বন্ধ রাখা এবং বায়ু বিশুদ্ধকারী ব্যবহার করা এই সমস্যা
থেকে স্থায়ীভাবে রেহাই দিতে পারে।
হাঁপানি রোগের লক্ষণ
হাঁপানি বা অ্যাজমা মূলত শ্বাসনালির একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত সমস্যা। এই
রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে দেখা দিলেও, অনেক সময় হঠাৎ করে তীব্র আকার ধারণ
করতে পারে। হাঁপানির প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো শ্বাস নিতে
কষ্ট হওয়া। অনেকেই বুকের মধ্যে চাপ অনুভব করেন, যেন বুকটা শক্ত হয়ে আছে বা
কিছু একটা চেপে বসেছে।
শুষ্ক কাশি হাঁপানির আরেকটি সাধারণ লক্ষণ যা রাতে বা ভোরের বেশি হয়। সেই
সঙ্গে ঘনঘন হাঁচি ও শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় সাঁসাঁ শব্দ হতে দেখা যায়। ঠান্ডা
আবহাওয়া, ধুলাবালি, ধোঁয়া, হাসি বা শারীরিক পরিশ্রম হাঁপানির লক্ষণগুলোকে
বাড়িয়ে দিতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে এই অসুখের লক্ষণ গুলো কিছুটা ভিন্ন হতে পারে যেমনঃ খেলাধুলা
করতে গেলে হঠাৎ কাশি বেড়ে যাওয়া, ঘুমের সময় বারবার কাশিতে ঘুম ভেঙে যাওয়া,
ক্লান্তিভাব দেখা দেওয়া।
হাঁপানি রোগের আধুনিক চিকিৎসা
বর্তমানে হাঁপানি বা অ্যাজমা চিকিৎসায় যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলো আগের
চেয়ে অনেক উন্নত, কার্যকর এবং রোগীর দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তোলার মতো
সক্ষম। আধুনিক চিকিৎসার মূল লক্ষ্য শুধু উপসর্গ কমানো নয়, বরং হাঁপানির মূল
কারণ নিয়ন্ত্রণ এবং ভবিষ্যতের যেন এই অসুখ থেকে ভালো থাকা যায় সেদিকে লক্ষ্য
রাখতে সহায়তা করে।
সবচেয়ে প্রচলিত এবং কার্যকর চিকিৎসা হলো ইনহেলার বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে
নেওয়া ওষুধ। এটি সরাসরি শ্বাসনালিতে কাজ করে, ফলে দ্রুত আরাম পাওয়া যায় এবং
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। আধুনিক ইনহেলারের মধ্যে রয়েছে দু’ধরনের ওষুধ -
- ১) রিলিভার (Reliever): যেমন Salbutamol বা Levosalbutamol, যা জরুরি অবস্থায় দ্রুত শ্বাসনালী প্রশস্ত করে।
- ২) কন্ট্রোলার (Controller): যেমন Budesonide, Fluticasone, Formoterol, বা Salmeterol, যেগুলো প্রতিদিন ব্যবহার করে হাঁপানিকে দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
এছাড়াও, ICS + LABA কম্বিনেশন ইনহেলার যেমনঃ Budesonide + Formoterol বা
Fluticasone + Salmeterol আধুনিক চিকিৎসায় খুবই কার্যকর হিসেবে বিবেচিত। এসব
ইনহেলার ফুসফুসে প্রদাহ কমায় এবং দীর্ঘ সময় শ্বাসনালী খোলা রাখে।
অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা Montelukast বা LTRAs জাতীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করে
থাকেন, যা দেরিতে দেখা দেওয়া হাঁপানির উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে ভালো কাজ করে।
তীব্র হাঁপানি হলে নেবুলাইজার থেরাপি, স্টেরয়েড ইনজেকশন, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে
বায়োলজিক থেরাপি (Biologics) ব্যবহার করা হয়, যেমনঃ Omalizumab, যা
অ্যালার্জি সম্পর্কিত হাঁপানিতে ব্যবহার হয়।
সার্বিকভাবে বললে, হাঁপানির আধুনিক চিকিৎসা এখন এতটাই উন্নত যে রোগীরা
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন শুধুমাত্র নিয়মিত চিকিৎসা ও জীবনযাত্রা
নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।
হাঁপানি কি ভালো হয়?
অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে হাঁপানি কি একেবারে ভালো হয়? উত্তরে এক কথায় বললে,
হাঁপানি বা অ্যাজমা একটি দীর্ঘমেয়াদি (chronic) রোগ, যার একমাত্র স্থায়ী
চিকিৎসা হয়তো নেই, কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে এটি
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অনেক রোগীই বছরের পর বছর ধরে হাঁপানির
কোনো লক্ষণ ছাড়াই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার
মাধ্যমে।
আরো পড়ুনঃ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ
শিশুদের মধ্যে অনেক সময় হাঁপানি দেখতে পাওয়া যায় এবং তাদের বয়স বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে এই হাঁপানি কমতে থাকে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এটি আজীবন থাকতে
পারে।
বর্তমানে আধুনিক ওষুধ ও ইনহেলারের মাধ্যমে হাঁপানির আক্রমণ রোধ, ফুসফুসের
প্রদাহ কমানো, এবং শ্বাসনালির শক্তি ধরে রাখা অনেক সহজ হয়েছে। তবে
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা বা ভুল ডোজে ওষুধ গ্রহন করা বা নিজে
নিজে হাঁপানির ওষুধ গ্রহণ করা ক্ষতিকর হতে পারে।
সুতরাং বলা যায়, হাঁপানি এখন আর এমন রোগ নয় যা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে।
নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন ও চিকিৎসা থাকলে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকা যায় অনেকটাই।
অ্যাজমা কত প্রকার?
অ্যাজমা এক ধরনের শ্বাসনালির প্রদাহজনিত দীর্ঘমেয়াদি রোগ হলেও, এটি সব সময়
একরকম নয়। উপসর্গ, কারণ এবং ট্রিগারের ভিত্তিতে অ্যাজমার কয়েকটি ভিন্ন ধরন
রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অ্যাজমা কয়েক প্রকারে ভাগ করা যায়, এবং
প্রতিটির চিকিৎসা পদ্ধতিও কিছুটা ভিন্ন হতে পারে যা একমাত্র চিকিৎসকরাই ভালো
জানেন। চলুন আমরা এখন কয়েক প্রকারের অ্যাজমা সম্পর্কে জেনে আসি।
- অ্যালার্জিক অ্যাজমা (Allergic Asthma): সবচেয়ে সাধারণ প্রকার। ধুলাবালি, ফুলের রেণু, পশুর লোম বা ছাঁচের মতো অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে এলেই উপসর্গ বেড়ে যায়।
- নন-অ্যালার্জিক অ্যাজমা (Non-Allergic Asthma): ঠান্ডা আবহাওয়া, ধোঁয়া, রাসায়নিক গন্ধ বা আবেগগত চাপ ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। এটি অ্যালার্জির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
- এক্সারসাইজ-ইনডিউসড অ্যাজমা (Exercise-Induced Asthma): দৌড়ানো বা ভারী ব্যায়ামের পর শ্বাসকষ্ট হয়, বিশেষ করে শীতকালে। শিশু ও তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
- অক্যুপেশনাল অ্যাজমা (Occupational Asthma): কাজের পরিবেশে যেমন ধুলা, গ্যাস, রাসায়নিক ইত্যাদির কারণে হয়। পেশাভিত্তিক কারণে অ্যাজমার উপসর্গ দেখা দেয়।
- নাইটটাইম অ্যাজমা (Nocturnal Asthma): রাতে ঘুমের মধ্যে কাশি, বুক ধরা, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ঘরের ধুলা, বিছানার ধুলা বা ঠান্ডা বাতাস প্রধান ট্রিগার।
- সিভিয়ার অ্যাজমা (Severe or Chronic Asthma): প্রচলিত ওষুধেও নিয়ন্ত্রণে না এলে একে সিভিয়ার বা কঠিন অ্যাজমা বলা হয়। উন্নত চিকিৎসা ও ইনহেলারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন হয়।
প্রতিটি ধরনের অ্যাজমার ট্রিগার ও চিকিৎসা ভিন্ন হতে পারে। তাই উপসর্গ বুঝে
শুনে নির্ণয় করা জরুরি, যাতে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করা যায়।
প্যারোক্সিসমাল নিশাচর শ্বাসকষ্ট কী?
প্যারোক্সিসমাল নিশাচর শ্বাসকষ্ট (Paroxysmal Nocturnal Dyspnea) হলো এমন এক
ধরনের শ্বাসকষ্ট, যা মূলত ঘুমের মধ্যে বা গভীর রাতে হঠাৎ করে শুরু হয়।
এই সমস্যা একদিনে হয় না কারণ এটি কোনো একটি রোগের লক্ষণ বা
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে,
Congestive Heart Failure (CHF) বা হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা থাকলে এটি
বেশি দেখা যায়। হৃদযন্ত্র যখন শরীরে ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে পারে না, তখন
ফুসফুসে অতিরিক্ত তরল জমে যায়। ফলে শুয়ে থাকলে শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি
হয়।
প্যারোক্সিসমাল নিশাচর এর বৈশিষ্ট্য:
- গভীর রাতে বা ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়
- বুক ধরা বা শ্বাস আটকে যাওয়ার অনুভূতি
- কাশি, ঘাম বা দুশ্চিন্তা হতে পারে
- বসে বা উঠে দাঁড়ালে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়
প্যারোক্সিসমাল নিশাচর শ্বাসকষ্ট কাদের বেশি হয়?
- যাদের হৃদযন্ত্রের রোগ আছে
- যাদের ক্রনিক ফুসফুসের রোগ (যেমন COPD) রয়েছে
- বয়স বেশি হলে এই সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে
- অতিরিক্ত ওজন বা সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে ঝুঁকি বাড়ে
হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে করণীয়
হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে অনেকেই ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু এমন সময়
সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী। এই সমস্যা নানা কারণে হতে পারে যেমনঃ হাঁপানি,
অ্যালার্জি, হৃদরোগ, প্যানিক অ্যাটাক কিংবা পরিবেশগত কারণে। তাই তাৎক্ষণিক
করণীয় ধাপগুলো জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ
- আতঙ্কিত হলে শ্বাস আরও ছোট ও দ্রুত হয়। গভীরভাবে ধীরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখুন।
- বিছানায় বা চেয়ারে হেলান দিয়ে না থেকে সোজা হয়ে বসে বুকের চাপ কমান, এতে শ্বাস নিতে সুবিধা হয়।
- গলার চারপাশে বা বুকের অংশে পোশাক ঢিলা করুন।
- ইনহেলার ব্যবহার করুন (যদি হাঁপানি থাকে), প্রয়োজনে একাধিকবার ব্যবহার করুন।
- সম্ভব হলে জানালা খুলে দিন বা ফ্যান চালান যাতে সতেজ বাতাস সহজে পাওয়া যায়।
- গলা শুকিয়ে গেলে ধীরে ধীরে পানি পান করুন।
- ব্রিদিং টেকনিক প্রয়োগ করুন।
- চিকিৎসা নিন দেরি না করে।
FAQs
১. ইনহেলার ও নেবুলাইজারের মধ্যে পার্থক্য কী?
ইনহেলার পকেট সাইজের যন্ত্র যা ডোজ কন্ট্রোল করে, আর নেবুলাইজার তরল ওষুধকে
বাষ্পে পরিণত করে ধীরে ধীরে শ্বাসনালিতে পৌঁছে দেয়।
২. কি ধরনের কাশিতে কফ সিরাপ উপকারী?
ভেজা কাশি বা চেস্টি কাশিতে এক্সপেক্টোরেন্ট বা মিউকোলাইটিক সিরাপ যেমন
অ্যামব্রক্সল, গাইফেনেসিন ইত্যাদি উপকারী।
৩. শুকনা কাশি বা ড্রাই কাশিতে কোন ওষুধ ভালো কাজ করে?
শুকনা কাশিতে বুটামিরেট সাইট্রেট বা ডেক্সট্রোমেথরফ্যান জাতীয় অ্যান্টিটাসিভ
ওষুধ কার্যকর, তবে এগুলো ঘুম ঘন করে দিতে পারে।
৪. সিজনাল অ্যালার্জিতে কোন জেনেরিক ওষুধগুলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর?
ফেক্সোফেনাডিন, সিটিরিজিন, রুপাটাডিন এবং লেভোসিটিরিজিন সিজনাল রাইনাইটিসে
সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
৫. Vasakarista কী ধরনের কাশিতে কার্যকর?
Vasakarista একটি হারবাল সিরাপ যা ভেজা কাশিতে কফ সহজে বের করতে সহায়তা করে।
৬. ইনহেলার ব্যবহারের পর কী করা উচিত?
ইনহেলার ব্যবহারের পর মুখ ভালোভাবে কুলকুচি করে ধুয়ে ফেলা উচিত যাতে মুখে
ফাঙ্গাল সংক্রমণ না হয়।
উপসংহার
স্বাস্থ্য সচেতনতা শুরু হয় সঠিক তথ্য জানার মধ্য দিয়ে। অনেকেই কেবল উপসর্গ দেখে
ওষুধ গ্রহণ করেন, কিন্তু জানেন না সেটি কতটা কার্যকর বা ক্ষতিকর হতে পারে। এই
কারণে ওষুধের জেনেরিক নাম ও কাজ জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট,
কাশি ও অ্যালার্জির মতো রোগে ব্যবহৃত ওষুধের ধরন, কাজ এবং প্রয়োগের ধরন
সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে তা ভুল চিকিৎসার দিকে যেতে পারে।
এই লেখায় আমরা চেষ্টা করেছি শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অ্যালার্জির ওষুধের জেনেরিক নাম
ও কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিতে। যেন আপনি ওষুধ সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন
এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। মনে
রাখবেন, স্বাস্থ্য সচেতনতা মানেই নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া।